ঢাকা ০৯:৫৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নবীজির জুমার খুতবা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৮:০৮:০৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭
  • ৫০৯ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সম্প্রতি ইসলাম নিয়ে গবেষণাকারী প্রাচ্যবিদদের কেউ কেউ প্রশ্ন ছুড়ছেন যে, বিদায় হজের খুতবা ছাড়া রাসুল (সা.) প্রদত্ত অন্যান্য খুতবা কোথায়? বিশেষত তার দেয়া জুমার খুতবাগুলো কোথায়? এ প্রশ্নের নেপথ্য আরেকটি বিষয়। অর্থাৎ তাদের সংশয় হলো যে, খুতবাগুলো হয়তো বিনষ্ট বা হারিয়ে গেছে! আর এ থেকে তারা এ ফল বের করতে চাচ্ছেন যে, ইসলাম ও ইসলামের নবীর সবকিছু বর্ণিত ও সংরক্ষিত নয়! সুতরাং ইসলামের সত্যতা বা মূল ইসলামের বিদ্যমানতা প্রশ্নবিদ্ধ!

আসল কথা হলো, যেভাবে ইসলাম ও ইসলামের নবীর সবকিছু নিখুঁতভাবে আজ অবধি সুরক্ষিত আছে, হাদিস ও সুন্নতের জ্ঞান যার মাঝে আছে, তার কাছে এসব দিবালোকের মতো স্পষ্ট। তথাপি উত্থাপিত সংশয়ের কী নিরসন, তা আমাদের জানা থাকা দরকার। প্রশ্নের সঠিক উত্তর বোঝতে হলে প্রথমে আমাদের কিছু বিষয় খেয়াল করতে হবে।

ভূমিকাস্বরূপ কয়েকটি কথা
এক. জুমার নামাজ কখন থেকে ফরজ হয়েছে, এ বিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে। তবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, মক্কায় জুমা আদায় করা হয়নি। তাছাড়া পবিত্র কোরআনের ‘সূরা জুমা’ তো মদিনায় অবতীর্ণ সূরাগুলোর অন্তর্ভুক্ত। আর প্রিয় নবী (সা.) মদিনায় ১০ বছর অবস্থান করেছিলেন।
দুই. নবীজির খুতবাগুলো আজকালকার খতিবদের খুতবার মতো ছিল না। বস্তুত সহিহ হাদিসে বিধৃত হয়েছে, দীর্ঘ নামাজ এবং সংক্ষিপ্ত খুতবা ব্যক্তির ফিকহ বা দ্বীনি সমঝের পরিচায়ক। অর্থাৎ খুতবা নামাজ থেকে সংক্ষিপ্ত হবে এবং কম সময় লাগবে।
তিন. জুমার খুতবা ছিল ওয়াজ তথা নসিহত ও দিকনির্দেশনামূলক। অর্থাৎ এখানে এমন কোনো মৌলিক বিধি-বিধান নেই; যা শুধু খুতবায় আলোচিত হয়েছে এবং পরে অনুল্লেখ থেকে গেছে। বরং বিধি-বিধান সংক্রান্ত নবীজির সব বাণী, চাই খুতবায় হোক বা অন্য কোনো সময়েÑ সব হাদিস গ্রন্থাদিতে সযতেœ উদ্ধৃত হয়েছে। খুতবায় বরং নসিহত ও উপদেশমূলক কথা বেশি বলা হতো এবং সেগুলোও সাহাবায়ে কেরাম স্বাভাবিক হাদিসগুলোর অধীনে বর্ণনা করে দিয়েছেন।

দ্বীন সংরক্ষণ এবং নবীজির খুতবা
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।’ (সূরা হিজর : ৯)। তাহলে আল্লাহ তাঁর জিকির সংরক্ষণের দায়িত্ব নিজেই নিয়েছেন। তাফসিরবিদদের ভাষ্যমতে, এখানে জিকির কোরআন ও সুন্নত উভয়টাকে শামিল রাখে। সুতরাং কোরআন যেভাবে চিরকাল সংরক্ষিত থাকবে, তেমনিভাবে সুন্নতও রক্ষিত থাকবে। মুহাদ্দিস ইমাম আবদুল্লাহ ইবনুল মোবারক (রহ.) কে জিজ্ঞেস করা হলো, তাহলে এ মওজু ও বানোয়াট বর্ণনাগুলোর ব্যাপারে কী বলবেন? প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, এসবের যাচাই-বাছাইয়ের জন্য হাদিসশাস্ত্রের প-িতরা জীবন উৎসর্গ করে দেন। এরপর তিনি পূর্বোদ্ধৃত আয়াতটি তেলাওয়াত করেন। মোটকথা, আমাদের পর্যন্ত যে সুন্নত ও হাদিস পৌঁছা জরুরি, আল্লাহ তায়ালা সেসবের পূর্ণাঙ্গ সংরক্ষণ করেছেন।

জুমার খুতবায় নবীজির সার্বিক অবস্থা
সাহাবায়ে কেরাম জুমার নামাজ এবং নবীজির খুতবা সংক্রান্ত সবকিছু বর্ণনা করেছেন। বরং খুতবার সময় নবীজি (সা.) এর সার্বিক অবস্থা কী ছিল, তাও সাহাবিরা পরবর্তীদের জানিয়ে গেছেন। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘খুতবার সময় নবীজির চোখ দুইটি লাল হয়ে যেত, স্বর উঁচু হয়ে যেত এবং রাগ বেড়ে যেত; যেন তিনি কোনো বাহিনীকে সতর্ক করছেন!’ (মুসলিম : ৮৬৭)।
তারা এও বর্ণনা করেছেন যে, নবীজি দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন, না বসে বসে। জাবির (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন, তারপর বসতেন, তারপর আবার দাঁড়াতেন। অতএব কেউ যদি তোমাকে সংবাদ দেয় যে, তিনি বসে বসে খুতবা দিতেন, তবে সে মিথ্যা বলল। আল্লাহর শপথ! তাঁর সঙ্গে আমি ২ হাজারবারেরও বেশি নামাজ আদায় করেছি।’ (মুসলিম : ৮৬২)।
জুমার নামাজে তিনি কোন কোন সূরা তেলাওয়াত করতেন, সাহাবিরা তাও আমাদের জানিয়ে গেছেন। উম্মে হিশাম (রা.) বলেন, ‘সূরা কাফ আমি নবীজির জবান থেকে শুনে শুনে মুখস্থ করেছি। কেননা প্রতি জুমায় মিম্বারে খুতবার মাঝে তিনি এ সূরাটি বেশি বেশি পাঠ করে থাকতেন।’ (মুসলিম : ৮৭৩)। নোমান ইবনে বাশির (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, ‘রাসূল (সা.) উভয় ঈদ এবং জুমার নামাজে সূরা আলা ও গাশিয়া তেলাওয়াত করতেন।’ (মুসলিম : ৮৭৮)।

হাদিস ও সিরাত গ্রন্থাদিতে খুতবা
মুহাদ্দিসরা নবীজি (সা.) এর ছোটবড় সব হাদিস বর্ণনার প্রতি মনোযোগী ছিলেন। সেজন্য হাদিস ও সুন্নতে নববি ভারে বিক্ষিপ্তভাবে ওইসব খুতবা বর্ণিত হয়ে গেছে। বোখারি-মুসলিমসহ হাদিসগ্রন্থাদিতে বহু বর্ণনার শুরুতে বর্ণনাকারী বলেন, ‘খাতাবানা’ অর্থাৎ নবীজি খুতবায় আমাদের বলেছেন অথবা ‘কামা ফিনা খাতিবান’ অর্থাৎ নবীজি খুতবায় দাঁড়িয়ে বললেন। এসব বর্ণনা মূলত নবীজি প্রদত্ত খুতবাগুলোরই উদ্ধৃতি। অন্যদিকে ঐতিহাসিকরা বিশদভাবে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে নবীজির পুরো জীবনবৃত্তান্ত সংকলন করেছেন এবং প্রাসঙ্গিক তারা বিভিন্ন পর্যায়ে নবীজি প্রদত্ত খুতবাগুলো নিজ নিজ স্থানে উদ্ধৃত করেছেন।

খুতবাবিষয়ক গ্রন্থাদি
নবীজির প্রচুর খুতবা সাহাবায়ে কেরাম হুবহু শব্দে বর্ণনা করেছেন। চাই তা জুমার খুতবা হোক বা ঈদের খুতবা কিংবা বিভিন্ন বিশেষ মুহূর্তের খুতবা হোক। হাদিস ও সুন্নতের কিতাবগুলো এসব বর্ণনায় ভরপুর। তন্মধ্যে কিছু বর্ণনা আছে বিশদ ও বিস্তারিত, কিছু আছে আংশিক ও সংক্ষিপ্ত, কিছু আছে যেগুলো বর্ণনাকারী নির্দিষ্ট কোনো বিষয় অথবা বিশেষ কোনো প্রেক্ষাপটে তদানুসারে বর্ণনা করেছেন। ফলে নবীজি প্রদত্ত ওইসব খুতবার মূল বাণীগুলো বিক্ষিপ্তভাবে একাধিক সাহাবি থেকে অনেক বর্ণনায় বিধৃত হয়ে গেছে। এজন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ওই খুতবাগুলো একত্রিত করে পৃথকভাবে স্বতন্ত্র গ্রন্থে সংকলনের কাজও করতে পেরেছেন বহু আলেম। সেই সংকলন কর্ম তৃতীয় শতাব্দী হিজরির শুরুর দিক থেকেই চালু হয়ে যায়। আলী ইবনে মুহাম্মাদ আল মাদায়িনি (২২৪ হি.), আবু আহমাদ আল আসসাল (৩৪৯ হি.), আবুশ শায়খ ইসফাহানি (৩৬৯ হি.), আবু নুয়াইম আল ইসফাহানি (৪৩০ হি.), জাফর ইবনে মুহাম্মাদ আল মুসতাগফিরি (৪৩২ হি.), মুহাম্মাদ ইবনে আলী আল মাওসিলি (৪৯৪ হি.), আবুল আব্বাস খিজির ইরবিলি (৫৬৭ হি.), নাসর ইবনে আহমাদ (৬১৯ হি.), মোল্লা আলী কারি (১০১৪ হি.) রাহিমাহুমুল্লাহ এবং তৎপরবর্তী আরও কতক মনীষী এ বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন।

বর্ণিত খুতবাগুলোর কিছু উদ্ধৃতি
তাছাড়া সিরাত ও তারিখবিষয়ক কোনো কোনো গ্রন্থে নবীজি প্রদত্ত কিছুকিছু খুতবা পরিপূর্ণভাবে উদ্ধৃত হয়েছে। মদিনায় এসে রাসুলুল্লাহু (সা.) সর্বপ্রথম জুমায় যে খুতবা প্রদান করেছিলেন, সেটা পুরোপুরিভাবে বিবৃত হয়েছে আল্লামা তাবারি (রহ.) এর ‘তারিখুর রাসুল ওয়াল মুলুক’ গ্রন্থে। ইমাম বায়হাকি (রহ.)ও তদীয় ‘দালায়িলুন নুবুওয়াহ’ (২/৩৮৫-৩৮৬) গ্রন্থে ভিন্ন সনদে ওই খুতবাটি বর্ণনা করেছেন। হাফিজ ইবনে কাসির (রহ.) মন্তব্য করেন, এসব সনদ একটি অপরটির জন্য সমর্থনকারী এবং সব মিলে একটি শক্তিশালী বর্ণনায় পরিণত হয়েছে, যদিও শব্দের কিছুটা ব্যবধান রয়েছে। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৩/২০)।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

নবীজির জুমার খুতবা

আপডেট টাইম : ০৮:০৮:০৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সম্প্রতি ইসলাম নিয়ে গবেষণাকারী প্রাচ্যবিদদের কেউ কেউ প্রশ্ন ছুড়ছেন যে, বিদায় হজের খুতবা ছাড়া রাসুল (সা.) প্রদত্ত অন্যান্য খুতবা কোথায়? বিশেষত তার দেয়া জুমার খুতবাগুলো কোথায়? এ প্রশ্নের নেপথ্য আরেকটি বিষয়। অর্থাৎ তাদের সংশয় হলো যে, খুতবাগুলো হয়তো বিনষ্ট বা হারিয়ে গেছে! আর এ থেকে তারা এ ফল বের করতে চাচ্ছেন যে, ইসলাম ও ইসলামের নবীর সবকিছু বর্ণিত ও সংরক্ষিত নয়! সুতরাং ইসলামের সত্যতা বা মূল ইসলামের বিদ্যমানতা প্রশ্নবিদ্ধ!

আসল কথা হলো, যেভাবে ইসলাম ও ইসলামের নবীর সবকিছু নিখুঁতভাবে আজ অবধি সুরক্ষিত আছে, হাদিস ও সুন্নতের জ্ঞান যার মাঝে আছে, তার কাছে এসব দিবালোকের মতো স্পষ্ট। তথাপি উত্থাপিত সংশয়ের কী নিরসন, তা আমাদের জানা থাকা দরকার। প্রশ্নের সঠিক উত্তর বোঝতে হলে প্রথমে আমাদের কিছু বিষয় খেয়াল করতে হবে।

ভূমিকাস্বরূপ কয়েকটি কথা
এক. জুমার নামাজ কখন থেকে ফরজ হয়েছে, এ বিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে। তবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, মক্কায় জুমা আদায় করা হয়নি। তাছাড়া পবিত্র কোরআনের ‘সূরা জুমা’ তো মদিনায় অবতীর্ণ সূরাগুলোর অন্তর্ভুক্ত। আর প্রিয় নবী (সা.) মদিনায় ১০ বছর অবস্থান করেছিলেন।
দুই. নবীজির খুতবাগুলো আজকালকার খতিবদের খুতবার মতো ছিল না। বস্তুত সহিহ হাদিসে বিধৃত হয়েছে, দীর্ঘ নামাজ এবং সংক্ষিপ্ত খুতবা ব্যক্তির ফিকহ বা দ্বীনি সমঝের পরিচায়ক। অর্থাৎ খুতবা নামাজ থেকে সংক্ষিপ্ত হবে এবং কম সময় লাগবে।
তিন. জুমার খুতবা ছিল ওয়াজ তথা নসিহত ও দিকনির্দেশনামূলক। অর্থাৎ এখানে এমন কোনো মৌলিক বিধি-বিধান নেই; যা শুধু খুতবায় আলোচিত হয়েছে এবং পরে অনুল্লেখ থেকে গেছে। বরং বিধি-বিধান সংক্রান্ত নবীজির সব বাণী, চাই খুতবায় হোক বা অন্য কোনো সময়েÑ সব হাদিস গ্রন্থাদিতে সযতেœ উদ্ধৃত হয়েছে। খুতবায় বরং নসিহত ও উপদেশমূলক কথা বেশি বলা হতো এবং সেগুলোও সাহাবায়ে কেরাম স্বাভাবিক হাদিসগুলোর অধীনে বর্ণনা করে দিয়েছেন।

দ্বীন সংরক্ষণ এবং নবীজির খুতবা
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি স্বয়ং এ উপদেশ গ্রন্থ অবতারণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।’ (সূরা হিজর : ৯)। তাহলে আল্লাহ তাঁর জিকির সংরক্ষণের দায়িত্ব নিজেই নিয়েছেন। তাফসিরবিদদের ভাষ্যমতে, এখানে জিকির কোরআন ও সুন্নত উভয়টাকে শামিল রাখে। সুতরাং কোরআন যেভাবে চিরকাল সংরক্ষিত থাকবে, তেমনিভাবে সুন্নতও রক্ষিত থাকবে। মুহাদ্দিস ইমাম আবদুল্লাহ ইবনুল মোবারক (রহ.) কে জিজ্ঞেস করা হলো, তাহলে এ মওজু ও বানোয়াট বর্ণনাগুলোর ব্যাপারে কী বলবেন? প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, এসবের যাচাই-বাছাইয়ের জন্য হাদিসশাস্ত্রের প-িতরা জীবন উৎসর্গ করে দেন। এরপর তিনি পূর্বোদ্ধৃত আয়াতটি তেলাওয়াত করেন। মোটকথা, আমাদের পর্যন্ত যে সুন্নত ও হাদিস পৌঁছা জরুরি, আল্লাহ তায়ালা সেসবের পূর্ণাঙ্গ সংরক্ষণ করেছেন।

জুমার খুতবায় নবীজির সার্বিক অবস্থা
সাহাবায়ে কেরাম জুমার নামাজ এবং নবীজির খুতবা সংক্রান্ত সবকিছু বর্ণনা করেছেন। বরং খুতবার সময় নবীজি (সা.) এর সার্বিক অবস্থা কী ছিল, তাও সাহাবিরা পরবর্তীদের জানিয়ে গেছেন। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘খুতবার সময় নবীজির চোখ দুইটি লাল হয়ে যেত, স্বর উঁচু হয়ে যেত এবং রাগ বেড়ে যেত; যেন তিনি কোনো বাহিনীকে সতর্ক করছেন!’ (মুসলিম : ৮৬৭)।
তারা এও বর্ণনা করেছেন যে, নবীজি দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন, না বসে বসে। জাবির (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন, তারপর বসতেন, তারপর আবার দাঁড়াতেন। অতএব কেউ যদি তোমাকে সংবাদ দেয় যে, তিনি বসে বসে খুতবা দিতেন, তবে সে মিথ্যা বলল। আল্লাহর শপথ! তাঁর সঙ্গে আমি ২ হাজারবারেরও বেশি নামাজ আদায় করেছি।’ (মুসলিম : ৮৬২)।
জুমার নামাজে তিনি কোন কোন সূরা তেলাওয়াত করতেন, সাহাবিরা তাও আমাদের জানিয়ে গেছেন। উম্মে হিশাম (রা.) বলেন, ‘সূরা কাফ আমি নবীজির জবান থেকে শুনে শুনে মুখস্থ করেছি। কেননা প্রতি জুমায় মিম্বারে খুতবার মাঝে তিনি এ সূরাটি বেশি বেশি পাঠ করে থাকতেন।’ (মুসলিম : ৮৭৩)। নোমান ইবনে বাশির (রা.) এর সূত্রে বর্ণিত, ‘রাসূল (সা.) উভয় ঈদ এবং জুমার নামাজে সূরা আলা ও গাশিয়া তেলাওয়াত করতেন।’ (মুসলিম : ৮৭৮)।

হাদিস ও সিরাত গ্রন্থাদিতে খুতবা
মুহাদ্দিসরা নবীজি (সা.) এর ছোটবড় সব হাদিস বর্ণনার প্রতি মনোযোগী ছিলেন। সেজন্য হাদিস ও সুন্নতে নববি ভারে বিক্ষিপ্তভাবে ওইসব খুতবা বর্ণিত হয়ে গেছে। বোখারি-মুসলিমসহ হাদিসগ্রন্থাদিতে বহু বর্ণনার শুরুতে বর্ণনাকারী বলেন, ‘খাতাবানা’ অর্থাৎ নবীজি খুতবায় আমাদের বলেছেন অথবা ‘কামা ফিনা খাতিবান’ অর্থাৎ নবীজি খুতবায় দাঁড়িয়ে বললেন। এসব বর্ণনা মূলত নবীজি প্রদত্ত খুতবাগুলোরই উদ্ধৃতি। অন্যদিকে ঐতিহাসিকরা বিশদভাবে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে নবীজির পুরো জীবনবৃত্তান্ত সংকলন করেছেন এবং প্রাসঙ্গিক তারা বিভিন্ন পর্যায়ে নবীজি প্রদত্ত খুতবাগুলো নিজ নিজ স্থানে উদ্ধৃত করেছেন।

খুতবাবিষয়ক গ্রন্থাদি
নবীজির প্রচুর খুতবা সাহাবায়ে কেরাম হুবহু শব্দে বর্ণনা করেছেন। চাই তা জুমার খুতবা হোক বা ঈদের খুতবা কিংবা বিভিন্ন বিশেষ মুহূর্তের খুতবা হোক। হাদিস ও সুন্নতের কিতাবগুলো এসব বর্ণনায় ভরপুর। তন্মধ্যে কিছু বর্ণনা আছে বিশদ ও বিস্তারিত, কিছু আছে আংশিক ও সংক্ষিপ্ত, কিছু আছে যেগুলো বর্ণনাকারী নির্দিষ্ট কোনো বিষয় অথবা বিশেষ কোনো প্রেক্ষাপটে তদানুসারে বর্ণনা করেছেন। ফলে নবীজি প্রদত্ত ওইসব খুতবার মূল বাণীগুলো বিক্ষিপ্তভাবে একাধিক সাহাবি থেকে অনেক বর্ণনায় বিধৃত হয়ে গেছে। এজন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) এর ওই খুতবাগুলো একত্রিত করে পৃথকভাবে স্বতন্ত্র গ্রন্থে সংকলনের কাজও করতে পেরেছেন বহু আলেম। সেই সংকলন কর্ম তৃতীয় শতাব্দী হিজরির শুরুর দিক থেকেই চালু হয়ে যায়। আলী ইবনে মুহাম্মাদ আল মাদায়িনি (২২৪ হি.), আবু আহমাদ আল আসসাল (৩৪৯ হি.), আবুশ শায়খ ইসফাহানি (৩৬৯ হি.), আবু নুয়াইম আল ইসফাহানি (৪৩০ হি.), জাফর ইবনে মুহাম্মাদ আল মুসতাগফিরি (৪৩২ হি.), মুহাম্মাদ ইবনে আলী আল মাওসিলি (৪৯৪ হি.), আবুল আব্বাস খিজির ইরবিলি (৫৬৭ হি.), নাসর ইবনে আহমাদ (৬১৯ হি.), মোল্লা আলী কারি (১০১৪ হি.) রাহিমাহুমুল্লাহ এবং তৎপরবর্তী আরও কতক মনীষী এ বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন।

বর্ণিত খুতবাগুলোর কিছু উদ্ধৃতি
তাছাড়া সিরাত ও তারিখবিষয়ক কোনো কোনো গ্রন্থে নবীজি প্রদত্ত কিছুকিছু খুতবা পরিপূর্ণভাবে উদ্ধৃত হয়েছে। মদিনায় এসে রাসুলুল্লাহু (সা.) সর্বপ্রথম জুমায় যে খুতবা প্রদান করেছিলেন, সেটা পুরোপুরিভাবে বিবৃত হয়েছে আল্লামা তাবারি (রহ.) এর ‘তারিখুর রাসুল ওয়াল মুলুক’ গ্রন্থে। ইমাম বায়হাকি (রহ.)ও তদীয় ‘দালায়িলুন নুবুওয়াহ’ (২/৩৮৫-৩৮৬) গ্রন্থে ভিন্ন সনদে ওই খুতবাটি বর্ণনা করেছেন। হাফিজ ইবনে কাসির (রহ.) মন্তব্য করেন, এসব সনদ একটি অপরটির জন্য সমর্থনকারী এবং সব মিলে একটি শক্তিশালী বর্ণনায় পরিণত হয়েছে, যদিও শব্দের কিছুটা ব্যবধান রয়েছে। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৩/২০)।